• বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪ ||

  • কার্তিক ৮ ১৪৩১

  • || ১৯ রবিউস সানি ১৪৪৬

‘যতদিন বেঁচে থাকব, জ্ঞান বিতরণ করে যাব’

– নীলফামারি বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৭ অক্টোবর ২০১৯  

ড. একেএম এমদাদুল হক। শৈশব থেকেই যিনি মেধাবী ছিলেন। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পাস করে উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হতেই তার প্রতি বিশেষ নজর দেন বাবা-মা। মেধাবী ছেলের যত্ন নিলে বড় হয়ে চিকিৎসক হবে। এমন ধারণায় পরিবারের দাবি উঠল অন্য ছেলে-মেয়েরা যেহেতু শিক্ষক, ব্যাংকারসহ নানা পেশায় আত্মনিয়োগ করতে যাচ্ছে, সেহেতু এমদাদও চিকিৎসক হোক। কিন্তু যিনি মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে শিক্ষকতাকে সম্মান করছেন, তিনি অন্য পেশায় যেতে নারাজ। তিনি বিনয়ের সঙ্গে সবাইকে বুঝাতে সক্ষম হন যে, তার মত মেধাবীরা যদি শিক্ষক হতে না পারে তাহলে দেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে উঠবে কিভাবে? পরে পেশাজীবনে তিনি পর পর দুই বার কুমিল্লার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হন। 

প্রচণ্ড মেধাবী আর অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও অন্য পেশায় না গিয়ে শিক্ষকতায় এলেন ড. এমদাদ। আর শিক্ষকতা পেশাও তাকে প্রতিদান দিতে বিমুখ করেনি। বর্তমানে তিনি কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড মডেল কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত।

এমদাদুল হকের পরিচয়:

১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের আমানগন্ডা ইউপির আমানগন্ডা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মো. আবদুস সামাদ আর মা সিরাজুননেছা। বাবা-মার ছয় ছেলে আর এক মেয়ের মধ্যে তিনি ষষ্ঠ। ব্যবসায়ী বাবা সন্তানদের পড়াশোনার ব্যাপারে তেমন সময় দিতে পারতেন না। তবে নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দকে বিসর্জন দিয়ে সাত সন্তানের সবাইকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করিয়েছেন মা সিরাজুননেছা। তাই বিভিন্ন সংগঠন মা সিরাজুননেছাকে রত্মাগর্ভা মা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

শিক্ষাজীবন:

চৌদ্দগ্রাম জেএইচ পাইলট হাইস্কুল থেকে এসএসসি, কুমিল্লা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এরপর একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এমফিল ডিগ্রিও অর্জন করেন। পলিটিক্যাল কালচারাল ইন বাংলাদেশ বিষয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। 

কর্মজীবন:

১৯৯৭ সালে ঢাকা লালমাটিয়া মহিলা কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, কুমিল্লা সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি ফেনী সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, কুমিল্লা ফেনী সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ এবং কুমিল্লা উচ্চ মাধ্যমিক টিচার্স ট্রেনিং কেন্দ্রে নিয়মিত প্রশিক্ষক ও রিসোর্স পার্সন হিসেবে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ২০০৬ সালে বিসিএস সাধারণ ক্যাডারে রাষ্ট্রপতির টেন পার্সেন্ট কোটায় তিনি সরাসরি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। 

তিনি ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড সরকারি মডেল কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন। তার আন্তরিক প্রচেষ্ঠায় এরইমধ্যে কলেজটি সরকারিকরণ হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। খুব সহসাই সরকারি কলেজ হিসেবে কার্যক্রম শুরু হবে। 

এমদাদুল হক কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড সরকারি মডেল কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব লাভ করার পরই তথ্য প্রযুক্তিসহ নানা দিক দিয়ে কলেজটিকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। বিশেষ করে সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে পলিসির সঙ্গে সংযোগ করে প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে এর আমূল পরিবর্তন আনেন। যা অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় হয়ে আছে। 

অর্জন: 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ওপর তার পাঁচটি বই দেশের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর লেভেলে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অর্ন্তভুক্ত রয়েছে। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, রাজনীতি বিজ্ঞানের সূচনা, সামাজিক গবেষণা পদ্ধতি ও পরিসংখ্যান, রাজনৈতিক তত্ত্ব ও পরিচিতি, রাজনৈতিক সংগঠন এবং ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থা, ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক উন্নয়ন প্রভৃতি।

২০১৭ ও ২০১৮ সালে কুমিল্লায় পর পর দুইবার শ্রেষ্ঠ জেলা কলেজ শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃতি পান ডা. এমদাদ। আর ২০১৯ সালে তিনি কুমিল্লার সদর দক্ষিণের শ্রেষ্ঠ উপজেলা কলেজ শিক্ষক হিসেবে পুরস্কার পান। এর আগে ফেনী জিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষক ছিলেন, সেখানে তিনি ২০১৬ সালে কলেজের শ্রেষ্ঠ শ্রেণি শিক্ষক হয়েছিলেন। তার অভিনব শিক্ষা পদ্ধতির কারণে তার নেতৃত্বে পরিচালিত কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড মডেল কলেজ দুই বার জেলার শ্রেষ্ঠ কলেজ নির্বাচিত হয়েছে।

এছাড়া তার বিভিন্ন ইতিবাচক কার্যক্রম যেমন- শৃ্ঙ্খলা, শিক্ষার্থীদের প্রায় শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ, অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্ষুধে বার্তা প্রেরণ ও ডেইলি কল সিস্টেম চালু, অনলাইনে প্রশ্ন গ্রহণ, মডারেশন, কোডিং সিস্টেম, গাইডিং কার্যক্রম, বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের ব্লাড গ্রুপিং, চক্ষু পরীক্ষা, প্রতি শনিবার প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, ক্লাস ক্যাপ্টেন ও শ্রেণি শিক্ষক কার্যক্রমকে অ্যাকটিভ ও আকর্ষণীয় করা, সাপ্তাহিক সভা করে বিগত সাত দিনের কার্যক্রম পর্যালোচনা করা, ভর্তি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা ডিজিটালাইজেশন,মনিটরিং সিস্টেম গতিশীলকরণ, গোটা ক্যাম্পাসকে পরিচ্ছন্ন রাখা ও সবুজায়ন করাসহ নিত্যনতুন উদ্যোগ ও কার্যক্রম গ্রহণের ফলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনাগত উৎকর্ষ সাধনে ব্যাপক সাফল্য এসেছে। যা শিক্ষা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে রোল মডেল। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখানে ভর্তির চাপ অনেক বেশি। 

এমদাদুল হক বলেন, ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’-এই ভাবসম্প্রসারণটিও আমাকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে। এরপর কলেজে গিয়ে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম না, জীবনে চাকরি করেই যদি ভাত খেতে হয়, তবে কেন মানুষ গড়ার চাকরি করব না। তাই বন্ধুবান্ধব, পরিবার-পরিজনকে ক্ষণিক সময়ের জন্য বিমুখ করে চিকিৎসা শাস্ত্রে পড়ার বিপক্ষে ছিলাম। যখন পরপর দুই বার জেলা শ্রেষ্ঠ শিক্ষক এবং এবার উপজেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হলাম। এখন সবাই গর্ববোধ করে।

তিনি বলেন, শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। এটি শ্রেষ্ঠ পেশাও বটে। তবে এ পেশায় টিকে থাকতে হলে পড়াশোনা করতে হয়। প্রচুর পড়াশোনা করেছি। এখনো করছি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পড়াশোনা করে যাব। জ্ঞান বিতরণ করে যাব। পড়া ও পড়ানো আমার নেশা। বর্তমানে প্রতিষ্ঠান প্রধান হলেও সময় পেলেই ক্লাসে চলে যাই। শ্রেণিকক্ষ সবচেয়ে আনন্দের জায়গা। জায়গাটি আমৃত্যু ধরে রাখতে চাই। 

ভবিষ্যৎ লক্ষ্য কি জানতে চাইলে ড. এমদাদ বলেন, মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মেধার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটানোই লক্ষ্য। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদান কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মানবসম্পদে পরিণত করা। নৈতিক মূল্যবোধ, মানবতাবোধ, দেশাত্মবোধ এবং সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমে সুনাগরিক হিসেবে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা। আর এ লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছি। ভবিষ্যত পরিকল্পনায় কলেজটিকে একটি পরিপূর্ণ মানসম্মত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করব। এ প্রতিষ্ঠানটিকে গ্রিন অ্যান্ড ক্লিন ক্যাম্পাসে পরিণত করেছি। এ প্রতিষ্ঠানের সুন্দর পরিবেশ, শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা এবং শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মচারী, অভিভাবক এবং রাজনৈতিক নেতাদের আন্তরিক সহযোগিতা কলেজেটি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। শিক্ষার্থীদের ভাল মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।

আগামীতে শিক্ষকতা পেশাটিকে কিভাবে দেখছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের মেধাবীরা চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ম্যাজিস্ট্রেট, ডিসি, সচিব নয়, শিক্ষক হতে একই প্রতিযোগিতা করবে। এমন চিত্র দেখতে চাই। প্রতিটি পরিবারে অন্তত একজন প্রাথমিক, মাধ্যমিক বা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দেখার স্বপ্ন। দেশে যত মেধাবী শিক্ষকতায় আসবে, তত বেশি মেধাবী নেতৃত্ব তৈরি হবে। এটাই জীবনের সবচেয়ে বড় চাওয়া।