• বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪ ||

  • কার্তিক ৮ ১৪৩১

  • || ১৯ রবিউস সানি ১৪৪৬

ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বিকল্প বালাইনাশক ব্যবস্থা

– নীলফামারি বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৯ অক্টোবর ২০১৯  

বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠা, বড় বড় কীটনাশক কোম্পানির ওপর আমাদের কৃষকরা অত্যন্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। যার ফলে, ফসল উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে বহুগুন। এতে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি যেমন আছে, সেই সাথে আমাদের কৃষকরা বড় বড় এইসব বহুজাতিক কোম্পানির কাছে এক প্রকার জিম্মি হয়ে আছে। এই বৃত্ত যদি আমরা ভাঙতে চাই, তাহলে আমাদের কৃষকদের বিকল্প বালাইনাশকের উপরে নির্ভর করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

জনবহুল বাংলাদেশে, আমাদের চাষযোগ্য জমির পরিমাণ খুবই সীমিত। এক টুকরো চাষযোগ্য জমি যে পরিমাণ মানুষের জন্য ফসল উৎপাদন করতে পারে, তার তিন থেকে চার গুণ বেশি মানুষের খাবারের চাহিদা রয়েছে দেশে। এটি এই মুহূর্তে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পথে আমাদের প্রধান অন্তরায়।

যেহেতু জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়, কাজেই এই সমস্যার সমাধানকল্পে আমাদেরকে যা করতে হবে তা হলো, বাংলাদেশের চাষযোগ্য জমির যে উৎপাদন ক্ষমতা, সেটা বাড়াতে হবে। আর এই উৎপাদন বৃদ্ধির প্রক্রিয়ার অত্যন্ত জরুরী হাতিয়ার হিসেবে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার প্রশ্নাতীত।

সমস্যা হলো, আমাদের কৃষক জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ অত্যন্ত দরিদ্র এবং স্বল্প শিক্ষিত অথবা নিরক্ষর। যে কারণে, কৃষি ক্ষেত্রে নিজস্ব উদ্ভাবিত প্রযুক্তি, প্রাকৃতিক বালাইনাশক ব্যবস্থা, ইত্যাদির প্রয়োগ ঘটানো, আমাদের দেশের কৃষকের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। ফলে তাদের নির্ভর করতে হয়, সম্পূর্ণভাবে রাসায়নিক কীটনাশক এবং রাসায়নিক সারের ওপর। প্রতিনিয়ত জমির ওপর এসব কীটনাশক এবং সারের প্রয়োগের ফলে মাটি এবং ফসল দুটোই হয়ে উঠছে বিষাক্ত। একই সাথে এটি পরিবেশ দূষণের জন্যেও দায়ী।

আমাদের দেশে প্রতি বছর, প্রায় ১৫ থেকে ২০ লক্ষ টন খাদ্যশস্য পোকামাকড় খেয়ে ফেলে বা নষ্ট করে ফেলে। ফলে নিরুপায় কৃষক ফসল সংরক্ষণ করতে যেয়ে যত্রতত্র কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করতে থাকে। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা যায়, আমাদের দেশের প্রায় ৫০০ প্রজাতির কীটপতঙ্গ, আমাদের নিজেদের দেশে প্রচলিত কীটনাশকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলেছে। এর ফলে প্রচলিত কীটনাশক দিয়েও এসব পোকামাকড়ের হাত থেকে কৃষকরা তাদের ফসল বাঁচাতে পারছেন না। একই সাথে তারা কীটনাশক কিনে এবং ফসল হারিয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে, জৈব কীটনাশকের ব্যবহার বা বিকল্প বালাইনাশক পদ্ধতির প্রয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কাজেই আমরা যদি একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষক থেকে শুরু করে সবার মধ্যে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহারের কুফল সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে পারি এবং বিকল্প বালাইনাশক ব্যবস্থা বা প্রাকৃতিক বালাইনাশক ব্যবস্থার ব্যাপারে তাদের অবহিত করতে পারি, তাহলেই শুধু এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।

সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, এসব জৈব বালাইনাশক বা বিকল্প ব্যবস্থা, যে কেউ তার বাড়িতে বসেই তৈরি করতে পারে। নিচে এমন কিছু প্রচলিত এবং জনপ্রিয় জৈব বালাইনাশক তৈরির সংক্ষিপ্ত উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

নিম

প্রাচীনকালে ভারতীয়রা, নিমের তেলকে শক্তিশালী বালাইনাশক হিসেবে অভিহিত করতেন। নিম গাছের পাতার রস তৈরি করে, সেটা প্রাকৃতিক বালাইনাশক হিসাবে ব্যবহার করা যায়। ১-২ আউন্স ভাল মানের অর্গানিক নিম ওয়েল (নিমের তেল), আধা চামচ মৃদু অর্গানিক তরল সাবান, আধা গ্যালন পানিতে আস্তে আস্তে নাড়াচাড়া করে মিশিয়ে নিতে হবে। এরপর তা বোতলে বা স্প্রেতে নিয়ে তৎক্ষণাৎ ব্যবহার করতে হবে।

লবণ স্প্রে

মাকড়সা, মাইট আক্রান্ত গাছের রোগ দমনের জন্য, ২ টেবিল চামচ হিমালয়ান ক্রিস্টাল সল্ট, ১ গ্যালন উষ্ণ গরম পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত স্থানে স্প্রে করতে হবে।

খনিজ তেল

১০-৩০ মিলি উচ্চ মাত্রার খনিজ তেল, ১ লিটার পানির সাথে মিশাতে হবে। তারপর নাড়াতে হবে এবং এরপর তা বোতলে বা স্প্রেতে নিয়ে তৎক্ষণাৎ ব্যবহার করতে হবে। এই জৈব বালাইনাশক, কীটপতঙ্গ এবং তাদের ডিম আর্দ্রতাশূন্য করে মেরে ফেলতে সাহায্য করে।

সাইট্রাস ওয়েল এবং সাইয়িন পিপার (গোল মরিচ)

১০ ড্রপ সাইট্রাস তেল, ১ চামচ সাইয়িন পিপার এবং এক কাপ উষ্ণ পানি মিশিয়ে ভালোভাবে ঝাঁকিয়ে আক্রান্ত স্থানে স্প্রে করতে হবে।

সাবান, অরেঞ্জ সাইট্রাস ওয়েল এবং পানি

৩ চামচ তরল জৈব সাবান, ১ আউন্স কমলালেবুর তেল ও ১ গ্যালন পানি একসাথে মিশাতে হবে। ভালোভাবে ঝাঁকিয়ে বোতলে বা স্প্রেতে নিয়ে ব্যবহার করতে হবে। পিঁপড়া এবং তেলাপোকা এর উপর এই স্প্রে প্রত্যক্ষভাবে প্রয়োগ করা যায়।

ইউক্যালিপটাস তেল

মাছি, মৌমাছি এবং বোলতা দমনের জন্য এই তেল ব্যবহৃত হয়। কয়েক ফোটা ইউক্যালিপটাস তেল ভালোভাবে ঝাঁকিয়ে বোতলে বা স্প্রেতে নিয়ে ব্যবহার করলে এগুলো গাছ থেকে সরে যায়।

রসুন, পেঁয়াজ ও অন্যান্য

এক কোয়া রসুন এবং একটি মাঝারী আকারের পিঁয়াজ এর সাথে, ১ গ্যালনের চারভাগের এক ভাগ পানি যোগ করতে হবে। এর পর ১ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে এবং তারপর ১ চামচ সায়ানিন পিপার এবং এক চামচ তরল সাবান যোগ করলেই তৈরি একটি উৎকৃষ্ট মানের জৈব কীটনাশক। এই জৈব স্প্রের মেয়াদ ৭ দিন থাকে, যদি ফ্রিজে সংরক্ষণ করা হয়।

ক্রিসেন্থিমাম ফ্লাওয়ার টি

এই ফুলের মধ্যে শক্তিশালী রাসায়নিক পদার্থ পাইরিথ্রাম থাকে। এই পদার্থ কীটপতঙ্গের নারভাস সিস্টেমকে আক্রমণ করে এবং নিশ্চল করে দেয়। ১ লিটার পানিতে ১০০ গ্রাম শুকনো ফুল, ২০ মিনিট গরম করে, ঠান্ডা করতে হবে। এখন স্প্রে বোতলে ঢেলে ব্যবহার করতে হবে। এটি ২ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যেতে পারে।

তামাক স্প্রে

তামাক মানুষের জন্য ক্ষতিকর, কৃষকের জন্য তেমন উপকারি। বিভিন্ন ধরণের বালাই, যেমন- পেস্ট, ক্যাটারপিলার, জাব পোকা দমণের জন্য এটি একটি কার্যকর বালাইনাশক। ১ কাপ অর্গানিক টোবাকো (তামাক পাতা) ১ গ্যালন পানিতে মিশাতে হবে। সারা রাত মিশ্রণটি রেখে দিতে হবে। ২৪ ঘন্টার পর এটি হালকা বাদামী রং ধারণ করবে। বেশী কালো হলে, বেশী পানি যোগ করতে হবে। সোলানেসী পরিবারের গাছ ছাড়া এটি সব গাছে স্প্রে করা যাবে।

এগুলো ছাড়াও আরও বিভিন্ন গাছ, ফল, পাতা এবং বীজ থেকে জৈব কীটনাশক তৈরি করা যায়। তাছাড়া বালাইনাশক আরও বিভিন্ন প্রাকৃতিক পদ্ধতি আছে। যেমনঃ

  • মেহগনি গাছের ফল/ বীজ থেকে বালাইনাশক!
  • সেক্স ফেরোমন!
  • আলোর ফাঁদ!
  • পার্চিং পদ্ধতিতে জমিতে বিভিন্ন গাছের ডালপালা পুতে পাখি বসার ব্যবস্থা করে পোকামাকড় দমন।
  • ধানক্ষেতে হাঁস ও মাছ চাষ করে পোকা দমন, ইত্যাদি অন্যতম।

আসল কথা হল- এই ব্যাপারগুলো যদি আমরা কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারি- তাহলে একদিকে যেমন আমাদের পরিবেশ ভাল থাকবে, অন্যদিকে কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারবেন। সেইসাথে আমাদের খাবারের প্লেটেও থাকবে বিষমুক্ত খাবার।