• শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||

  • আশ্বিন ৪ ১৪৩১

  • || ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

প্রচলিত কিছু ভুল ও জাল হাদীস

নীলফামারি বার্তা

প্রকাশিত: ২২ নভেম্বর ২০১৮  

আমাদের সমাজে অনেক ভুল কথা ও প্রথার প্রচলন আছে। সমাজের কিছু প্রচলন ও উক্তিকে অনেক সময় ধর্ম বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা যুগ যুগ ধরেই হয়ে এসেছে।

অনেকে এটিকে ষড়যন্ত্রমূলক চালিয়ে দিয়েছেন কেউ ভুল ধারণা থেকে করেছেন। সময়ের প্রবাহে এসব মানুষের মনে বিশ্বাসযোগ্য জায়গাও করে নিয়েছে।

বিশেষভাবে মানুষের মুখে-মুখে এমন কিছু কথা প্রচলিত আছে, যা অনেকেই হাদিস বা রাসূল (সা.) এর কথা হিসেবে জানেন। অথচ প্রচলিত এই কথাগুলোর সঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর বাণীর আদৌ সম্পর্ক নেই। এগুলোকে বলে, জাল হাদিস।

এসবের ভিত্তি পবিত্র কোরআন হাদীসের কোথাও নেই। ওলামায়ে কেরাম এসবের কোনো প্রমাণ পাননি। জাল হাদিসের মতো এমন ঘটনা কেবল আমাদের সময়ে ঘটেছে, আগে ঘটেনি তা কিন্তু নয়। আগের যুগেই এ ঘটনার উৎপত্তি।

বিশেষজ্ঞদের মতে ৩৬ হিজরিতে এর সূচনা। তা প্রতিরোধের জন্য উম্মতের অতন্দ্র প্রহরী প্রখর ধী-শক্তিমান মুহাদ্দিসবৃন্দ নিরন্তর সাধনা করে রাসূল (সা.) হাদিস সংরক্ষণের জন্য এক নতুন শাস্ত্র তৈরি করেছেন। যাকে বলা হয় রিজাল শাস্ত্র বা সূত্রের ধারাবাহিকতা।

এই শুদ্ধিকরণ মানদণ্ডে যেটা উত্তীর্ণ হবে কেবল সেটাই হাদিস বলে বিবেচিত হবে। এই নিখুত ছাঁকনির বদৌলতে আজ আমরা রাসূল (সা.) ও তাঁর সাহাবিদের সঠিক দিক-নির্দেশনাগুলো পেয়েছি। আমরা জাল হাদিসসহ সমাজের নানা অসঙ্গতি ও কুসংস্কার তুলে ধরবো।

আপনি না হলে আসমান মহাবিশ্ব সৃষ্টি করতাম না:

লোকমুখে এটি হাদিসে কুদসি হিসেবে যথেষ্ট প্রসিদ্ধ। অথচ হাদিস বিশারদগণ একমত যে, এটি অবান্তর, ভিত্তিহীন ও মিথ্যা বর্ণনা। বিশিষ্ট মুহাদ্দিস আল্লামা সাগানি (রহ.), মোল্লা আলি কারি ও আবদুল হাই লাখনবিসহ অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ একবাক্যে একে জাল বলেছেন। হাদিসের সঙ্গে আপনি না হলে আসমান মহাবিশ্ব সৃষ্টি করতাম না-এর কোনো সম্পর্ক নেই। (সূত্র : আল্লামা সাগানি, আল-মাউজুয়াত: পৃ. ৫২ ; মোল্লা আলি কারি, আল-আসরার, পৃ ১৯৪ ; আল-মাসনু, পৃ. ১১৬ ; আল-আজলুনি, কাশফুল খাফা ২/২১৪)

জ্ঞান অন্বেষণের জন্য সুদূর চীন দেশে যাও:

বাক্যটি আমাদের দেশে হাদিস হিসেবে খুব প্রসিদ্ধ। অথচ তা হাদিস নয়, বরং আরবি ভাষার প্রবাদ। অধিকাংশ মুহাদ্দিস একে জাল বলেছেন। তবে কথাটির বক্তব্য পুরোপুরি ঠিক আছে। জ্ঞানার্জনের জন্য দূরত্ব যতই হোক, সামর্থ থাকলে যাওয়া উচিৎ। কিন্তু আলোচ্য বাক্যটি হাদিস নয়। এ বাক্যটির বর্ণনার সনদে আবু আতিবা তরিফ ইবনে সুলায়মান নামে একজন বর্ণনাকারী আছে, যে হাদিস শাস্ত্রের ইমামদের কাছে অগ্রণযোগ্য বলে স্বীকৃত। (সূত্র : উকায়লি, আফাউল কাবির ২/২৩০; ইবনে হিব্বান, কিতাবুল মাজরহিন ১/৩৮২।)

জ্ঞানীর কলমের কালি শহিদের রক্তের চেয়ে বেশি পবিত্র:

এই হাদিসটি আল-খাতিব আল-বাগদাদি তার হিস্টোরি অব বাংলাদেশ ২/১৯৩ বইয়ে বর্ণনা করেছেন এবং একে জাল বলে প্রমাণ করেছেন। এই হাদিসটি ইসলামের দাওয়াতের কাজকে ইসলামের জন্য সংগ্রাম করা থেকে বেশি সম্মান দেয়। এটি আগেকার দিনের কাপুরুষরা, যারা জিহাদে যেতে ভয় পেত, তারা প্রচার করতো, যাতে করে তারা জিহাদে অংশগ্রহণ করা থেকে পালিয়ে থাকতে পারতো।

পবিত্র কোরআনে এর সম্পূর্ণ বিপরীত বাণী রয়েছে, শারীরিকভাবে অক্ষম ছাড়া যে সব বিশ্বাসীরা ঘরে বসে থাকে, তারা কোনোভাবেই তাদের সমান নয়, যারা নিজেদের জান এবং সম্পদ দিয়ে মহান আল্লাহর পথে জিহাদ করে। যারা ঘরে বসে থাকে, তাদের থেকে মুজাহিদদের পদমর্যাদা আল্লাহ বাড়িয়ে দিয়েছেন। যদিও তিনি সকল বিশ্বাসীদেরকেই সুন্দর প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কিন্তু যারা ঘরে বসে থাকে তাদের থেকে মুজাহিদদের আল্লাহ অকল্পনীয় বেশি প্রতিদান দেন। (৪:৯৫)

তবে মনে রাখবেন, জিহাদ মানেই ‘আল্লাহু আকবার’ বলে অমুসলিমদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া নয়। জিহাদ শব্দের অর্থ আপ্রাণ চেষ্টা করা, কোনো কিছু অর্জনের জন্য সংগ্রাম করা। যেমন, কুপ্রবৃত্তি দমনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করাটা একটি জিহাদ। পরিবার, সমাজ ও দেশের অন্যায় সংস্কৃতি থেকে নিজেকে দূরে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করাটাও জিহাদ।

একইভাবে নিজের কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ যে সর্বোত্তম জিহাদ বলে একটা হাদিস প্রচলিত আছে, সেটাও ভুল। ইবন তাইমিয়্যাহ বলেছেন, কিছু লোক একটা হাদিস প্রচার করে যে, নবী মুহাম্মাদ নাকি তাবুকের যুদ্ধের পর এসে বলেছিলেন, ‘আমরা একটা ক্ষুদ্রতর জিহাদ থেকে ফেরত এসে একটা বৃহত্তর জিহাদে আসলাম।’ এই হাদিসের কোনো ভিত্তি নেই, ইসলামিক শিক্ষার সঙ্গে জড়িত কোনো পণ্ডিত এই হাদিস বর্ণনা করেননি। কুফরি শক্তির বিরুদ্ধে জিহাদ নিঃসন্দেহে সবচেয়ে মহৎ কাজ, এবং শুধু তাই না, এটি মানবজাতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজের একটি। (ইবন তাইমিয়্যাহ আল ফুরকান, পৃষ্ঠা:৪৪-৪৫)

স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত:

‘স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত’ এ কথাটি আমাদের সমাজে প্রচলন রয়েছে। মূলত স্বামীর প্রতি স্ত্রীর সম্মান মর্যাদার গুরুত্ব বুঝাতে এ কথাটি বলা হয়ে থাকে। অথচ হাদিসে এ ধরণের কোনো কথা বলা নেই। স্বামীর-স্ত্রীর ভালোবাসা ও সম্মান উভয়ের প্রতি উভয়ের সমানভাবেই থাকা উচিত। কারও জন্য কাউকে ছোট বড় করা উচিত নয়। এ কথার সুযোগে আমাদের সমাজে স্ত্রীদের দাসি বানিয়ে রাখার প্রবনতা দেখা যায়। অথচ ইসলাম এর সমর্থণ করে না। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভক্তি শ্রদ্ধার বুঝানোর জন্য এ ধরণের অনেক কথা হাদিসে বলা হয়েছে। তবে ‘স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত’ এ ধরণের কোনো কথা বলা হয়নি।

মুআত্তা মালেক, মুসনাদে আহমাদ, মুসতাদরাকে হাকেমসহ হাদীসের আরো কিছু কিতাবে বর্ণিত হয়েছে, একবার এক নারী সাহাবী রাসূল (সা.) এর কাছে এলেন নিজের কোনো প্রয়োজনে। যাওয়ার সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি স্বামী আছে? তিনি বললেন, জী, আছে। নবীজি বললেন, তার সঙ্গে তোমার আচরণ কেমন? সে বলল, আমি যথাসাধ্য তার সঙ্গে ভালো আচরণ করার চেষ্টা করি। তখন নবীজি (সা.) বললেন, হ্যাঁ, তার সঙ্গে তোমার আচরণের বিষয়ে সজাগ থাকো, কারণ সে তোমার জান্নাত বা তোমার জাহান্নাম। (মুআত্তা মালেক, হাদীস ৯৫২; মুসনাদে আহমাদ, ৪/৩৪১ হাদীস ১৯০০৩; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ২৭৬৯; সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস ১৪৭০৬)

স্বামী-স্ত্রীর একের ওপর অন্যের অধিকার রয়েছে। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনুল কারীমে মৌলিক নির্দেশনা দিয়েছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর স্বামীদের যেমন তাদের (স্ত্রীদের) ওপর ন্যায়সঙ্গত অধিকার রয়েছে, তেমনি তাদেরও অধিকার রয়েছে স্বামীদের ওপর।’ (সূরা বাকারা ২ : ২২৯)

আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিস্তারিত স্বামী-স্ত্রীর হক তুলে ধরেছেন এবং স্বামীদেরকে স্ত্রীর হক আদায়ের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। বিদায় হজের ভাষণে নবীজি বলেছেন, তোমরা নারীদের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় কর। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১২১৮)

সঙ্গে সঙ্গে নারীদের স্বামীর আনুগত্য করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং এর ফজিলতও বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, নারী যখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ঠিকমত আদায় করবে, রমজানের রোজা রাখবে, আপন লজ্জাস্থানের হেফাযত করবে, স্বামীর আনুগত্য করবে তখন সে জান্নাতের যেই দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করতে পারবে। (সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৪১৬৩)

সুতরাং গুনাহের কাজ নয় এমন বিষয়ে স্বামীর আনুগত্য জরুরি। কিন্তু ‘স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত’ এটি হাদীস নয়। এ ধরণের কথা বলে স্ত্রীদের ঘরের দাসি বানিয়ে রাখাও উচিত নয়।

মুসাফাহার প্রচলিত দুটি ভুল:

অনেককে দেখা যায় কোনো বুযুর্গ বা বড় ব্যক্তির সঙ্গে মুসাফাহা করার সময় কিছুটা ঝুঁকে যান। অথচ কারো সম্মানার্থে মাথা বা ঘাড় ঝুঁকানোর অনুমতি নেই। এক সাহাবি রাসূল (সা.)-কে বললেন, ‘কোনো ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাত হলে কি মুসাফাহা করব’- এ প্রশ্নের উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, হ্যাঁ, মুসাফাহা কর। এরপর জিজ্ঞাসা করা হলো, তার সামনে কি ঝুঁকতে পারি? নবী (সা.) বললেন, না। ঝুঁকা যাবে না। (জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৭২৮; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ৩৭০৩)

মুসাফাহার পর বুকে হাত লাগানো:

আবার অনেককে দেখা যায়, মুসাফাহার পর বিশেষ করে কোনো সম্মানি ব্যক্তির সঙ্গে মুসাফাহার পর ডান হাত নিজের বুকে মুছে নেন। কী নিয়তে এমনটি করেন-তা জানা নেই। সম্ভবত এই নিয়ত হতে পারে যে, মুসাফাহার দ্বারা যে বরকত হলো তা নিজ শরীরে মুছে নেওয়া। এই প্রচলনের যেমন কোনো ভিত্তি নেই তেমনি এই নিয়তেরও।

এই ছোট ছোট বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতনতা এজন্য জরুরি যে, ধীরে ধীরে তা রসম-রেওয়াজে পরিণত হয়ে যায়। এ নিয়ে পরস্পর দ্বন্দ সৃষ্টি হয়। এমনকি মূর্খতাপ্রসূত এই রেওয়াজ একপর্যায়ে বিদআত পর্যন্ত পৌঁছে যায়।

সালামের জবাবে ‘অলাইকুম সালাম’ বলা:

আমাদের অনেকেরই সালাম দিতে গিয়ে বা সালামের উত্তর দিতে গিয়ে অজান্তেই ভুল হয়ে যায়। সালাম একটি দোয়া। ইসলামের নিদর্শন ও প্রতীক পর্যায়ের একটি আমল। এর সহীহ উচ্চারণের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। কমপক্ষে এতটুকু বিশুদ্ধ উচ্চারণ অবশ্যই জরুরি, যার দ্বারা অর্থ ঠিক থাকে-

وَعَلَيْكُمُ السَّلَامُ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُه

‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম, ওয়া রাহমাতুল্লাহি, ওয়া বারাকাতুহু’

আরবি দেখে এর সহীহ উচ্চারণ শিখে নেওয়া উচিত। অন্যথায় ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম’ এর স্থলে ‘অলাইকুম...’ হয়ে যায়, যা স্পষ্ট ভুল।

আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, আমরা অনেক সময়ই সালামের পূর্ণ জবাব দিতে কার্পণ্য করে থাকি। পুরো উত্তর বলি না, দায়সারাভাবে উত্তর দিই। অথচ মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনেই শিখিয়েছেন; কেউ সালাম দিলে তার চেয়ে উত্তম শব্দে উত্তর দেয়া চাই।

সূরা নিসার ৮৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,

وَإِذَا حُيِّيْتُم بِتَحِيَّةٍ فَحَيُّواْ بِأَحْسَنَ مِنْهَا أَوْ رُدُّوهَا إِنَّ اللّهَ كَانَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ حَسِيبًا

অর্থ: ‘আর তোমাদেরকে যদি কেউ দোয়া করে, তাহলে তোমরাও তার জন্য দোয়া কর; তারচেয়ে উত্তম দোয়া অথবা তারই মত ফিরিয়ে বল। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ব বিষয়ে হিসাব-নিকাশ গ্রহণকারী।’